তাঁতের শাড়ি এর গুনাবলি কি কি?

বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম শিল্প হলো তাঁত। তাঁত শিল্পে মণিপুরিরা অনেক আদিকাল থেকে তাঁতবস্ত্র তৈরি করে আসছে। একই সুতায় রঙ-ডিজাইন করে উৎপাদন হচ্ছে শাড়ি।এখানকার তাঁতিরা শুধু সুতি সুতাকে উপজিব্য করে নিজের দক্ষতায় তৈরি করেন তাঁতের শাড়ি, যা বেশ আরামদায়ক, রুচিশীল ও মার্জিত। এখানকার শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কাজ।

সংস্কৃত ‘তন্তু’ থেকে বাংলা ‘তাঁত’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে।তবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত তাঁতযন্ত্রের নানা রকম প্রকারভেদ রয়েছে। বাংলার বিখ্যাত মসলিন ও অন্যান্য বস্ত্র পিটলুম বা গর্ত তাঁতেই তৈরি হতো।ঢাকার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপগঞ্জ-সোনারগাঁ অঞ্চলে এখনো সাধারণ গর্ত তাঁতেই নকশাদার জামদানি শাড়ি বয়ন করা হয়।


তাঁতের শাড়ির গুনাবলির কথা বলে শেষ করা যাবে না। এ শাড়ির অনেক কদর রয়েছে।সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী নকশায় এখন তাঁতের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। তাঁতে তৈরি হচ্ছে তাঁতের সুতির শাড়ি, দেবদাস, জামদানি, সুতি জামদানি, জরি পাড়, সানন্দা, স্বর্ণচূড়, কুমকুম, কটকি,  ময়ূরকণ্ঠী,  সুতিপাড়, নিলাম্বরী, হাজারবুটি, আধা রেশমি, ইককাত, সিল্ক, মণিপুরি, সুতিসিল্ক, হাফসিল্ক, বালুচরি, শান্তিপুরি, আনারকলি, সফটসিল্ক, গ্রামীণ চেকসহ নানা বাহারের ও নামের শাড়ি।


বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক।তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাঁতের শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাড় বা কিনারার কাজ।অন্যান্য শাড়ি ১০-১২ হাত মাপে হলেও এই শাড়ি তৈরি হয় ১৪ হাত মাপে। তাঁতের শাড়ি তৈরির জন্য ১০০, ৮০, ৮২, ৮৪ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়। এ শাড়ি পড়তে বেশ নরম ও আরাম অনুভব হয় টেকেও অনেক দিন।


নরম ও আরামদায়ক বলে সবচেয়ে বেশি কদর বাড়ে তাঁত কাপড়ের।শরতের কাশবন আর সাদা তুলোর মতো মেঘের দিনে হালকা আসমানি রঙের সুতি শাড়িতে গাঢ় চিকন ডুরে পাড়ের শাড়ি- ভাবতেই চোখের সামনে একটি স্নিগ্ধ সুন্দর প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে। হালকা গোলাপি, নীল, আসমানি, সবুজ ইত্যাদি রঙের শাড়ি ভালো লাগবে এ সময়।

তাঁতের শাড়িতে অলঙ্করণ করে বৈচিত্র্য আনা যায় খুব সহজেই ও দারুণভাবে। অ্যাপ্লিক, ব্লকপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারি, হাতের কাজ অলঙ্করণ মাধ্যম হিসেবে অধিক জনপ্রিয়। কিন্তু ইদানীং স্ট্ক্রিনপ্রিন্টের প্রচলন অনেক বেশি। বিভিন্ন ধরনের মোটিফ ব্যবহার হচ্ছে, মোটিফেও নতুনত্ব এসেছে খুব। ফিগারটিভ, গল্প-কাহিনীভিত্তিক মোটিফ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাঁতের সুতি শাড়িতে কোনো কোনো ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে দেশি ও সংস্কৃতিনির্ভর নকশা।  বিশেষ চরিত্রনির্ভর মোটিফ বা গল্পনির্ভর কোনো ব্যক্তি হচ্ছে, সংলাপ কবিতা বা যে কোনো লেখাকে মোটিফ হিসেবে শাড়িতে ব্যবহার খুব চলছে এখন।

মোটা পাড়ের শাড়ি যেমন নারীর পছন্দ, ঠিক তেমনি সরু পাড়ের শাড়িও। যারা একটু লম্বা, মোটা পাড়ের শাড়ি তাদের মানিয়ে যায় খুব। বিশেষ করে তাঁতের শাড়িতে সরু পাড়ের শাড়িগুলোর জমিনে কাজ থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। চেক ও স্ট্রাইপ শাড়ির প্রিন্ট হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। কিছুদিন আগেও কুচি প্রিন্টের খুব চল ছিল।এখন শুধু কুচির জায়গায় অন্যরকম নকশা।লম্বালম্বি চেক ও  আড়াআড়ি চেক, দু’রকমই ভালো লাগে শাড়িতে। তাঁতিরা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা পরিচয় দেন প্রতিটি শাড়িতেই। নকশা-কাজ, রঙের ব্যবহার, ডিজাইনে নতুনত্ব দেখলে বোঝা যায়, এই শাড়ি কতটা দক্ষ ও বিচক্ষণ।


যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে মানানসই ও রুচিশীল পোশাক হচ্ছে তাঁত শাড়ি । অফিসে যাওয়ার শাড়ি হিসেবে বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ হচ্ছে তাঁতের শাড়ি। এ ছাড়া আড্ডা, দাওয়াত বা বাইরে যাওয়ার জন্য আরামদায়ক ও রুচিশীল মাধ্যম হচ্ছে তাঁতের শাড়ি। এই শাড়ির সঙ্গে হালকা মেকআপ ও গহনা পরে চলে যাওয়া যায় যে কোনো কাজে। তাই  অনেকেই অফিস শেষে দাওয়াতে যেতে পড়েন বিপাকে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে তাঁত শাড়ি এনে দিতে পারে সমাধান ও স্বস্তি। এই তাঁতের শাড়ি রঙের জন্য জনপ্রিয় সব সময়। অন্য সব সুতা থেকে তাঁতের সুতার রঙ সুন্দর ও সঠিক হয়। আর এই তাঁতের শাড়িতে মনমতো কম্বিনেশন পাওয়া যায়।


তাঁত শাড়ির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যুগে যুগে জনপ্রিয়তা কমার পরিবর্তে বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। বর্তমানে ফ্যাশন জগতে যারা নতুন পা রাখছেন, তাদের অনেকেই তাঁত নিয়ে কাজ করছেন। সাথে বেরিয়ে আসছে নতুনত্ব, তৈরি হচ্ছে নতুন শাড়ি নতুন ডিজাইনে।

তাঁত শাড়ির নাম শুনলেই চোখ বন্ধ করে সবার আগে মনে পড়ে যায় টাঙ্গাইলের নাম। যদিও বর্তমানে মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জেও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে তাঁতের শাড়ি। এছাড়া পাবনা, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়াও তাঁতের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা। যেন একেক এলাকার শাড়ির বৈশিষ্ট্য একেক রকম। যেমন ঠাকুরগাঁওয়ের তাঁত একটু মোটা ও ভারী। আর পাবনার তাঁত নরম ও পাতলা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় তাঁত শাড়ির দাম। কিন্তু তাঁতিদের কাছে ৪০০ থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত দামের তাঁতের শাড়ি পাওয়া যায়। তাঁতের শাড়ি  দাম, আরামদায়কতা ও সহজলভ্যতা- এই ১২ হাত লম্বা বস্ত্রের জনপ্রিয়তা ধরে রাখছে যুগের পর যুগ।